বিছানায় মাকে নিজের সামনে বসিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে সাদা কাপড়ের টুকরো টা বের করে মাকে দেখিয়ে যখন বললাম ‘এটা আমার কাফনের কাপড়’ তখন মা হতভম্ব হয়ে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন,আর একবার সেই ধবধবে সাদা কাপড়ের টুকরোটার দিকে তাকাচ্ছিলেন। মাকে এমন হতভম্ব হতে দেখে আমি বেশ মজা পেয়ে হেসে ফেললাম। মাকে মাঝে মাঝে এভাবে ভয়ংকর ভাবে চমকে দিতে বেশ লাগে। যদিও আজকের মতো এমন ভয়ংকর, অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ এর আগে কখনো করি নি।
যাইহোক,আমি হেসে দিয়ে মাকে বললাম, “এত টাস্কি খাওয়ার মতো কিছু হয় নাই মা।” মা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “টাস্কি খাওয়ার মতো কিছু হয় নাই মানে কী? আর এইটা তোর কাফনের কাপড় সেইটারই বা মানে কী? মাথা ঠিক আছে তোর?” আমি হাসতে হাসতে কাপড় খানা আবার শপিং ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে আপনমনে বলতে থাকলাম, “কে কখন মারা যায় কে জানে বলো? মৃত্যু আমাদের সবচে’ কাছে। অথচ আমরা এই মৃত্যুকেই প্রতিনিয়ত বেমালুম ভুলে যাই!” এরপর মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললাম, “তাই কাফনের কাপড় টা এনে রাখলাম। যাতে প্রতিদিন অন্তত একনজর করে হলেও এই কাপড়টা দেখতে পারি আর উপলব্ধি করতে পারি যে মৃত্যু আমার খুব কাছে! খুউউব!” আমার কথা শুনে মায়ের চোখ ছলছল করে। ধরা গলায় বলল, “তাই বলে এখনই তোর এই ব্যবস্থা করে রাখা লাগবে? এখন তো নাও মরতে পারিস।” আমি হেসে মায়ের কথার পৃষ্ঠে বললাম, “আবার এখন মরতেও তো পারি। বলা তো যায় না কিছুই।
বাবাকে,ভাইদেরকেও এই কাপড়খানা দেখিয়ে রাখবো। যাতে এরমধ্যে আমি মারা গেলে এই কাপড়েই যেন আমাকে জড়িয়ে দেয়।” কথাটুকু বলে আমি কাপড়ের ব্যাগটা ওয়্যারড্রপের এককোণে রেখে আমার রুমে চলে আসলাম। আমি জানি,মা এখনো হতভম্ব হয়ে বসে আছে। মা কি আমাকে পাগল ভাবছে? ভাবুক! পাগল তো আমাকে দোকানদার চাচাও ভেবেছিল! কলেজ থেকে আসার পথে আমাদের স্থানীয় বাজারের পরিচিত দোকানটায় গিয়ে যখন বললাম ‘চাচা,কাফনের কাপড় লাগবে’ তখন দোকানদার চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে মারা গেছে?” “কেউ মারা যায় নাই চাচা।” “তাইলে কাফনের কাপড় চাইলা যে?” “অগ্রীম কিনে রেখে দিবো।” চাচা এবারে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কার জন্যে কিনে রাখবা?” বললাম, “আমার জন্যই।”
চাচা কপাল কুচকে বললেন, “পাগল হইছ তুমি? তোমার বয়স কত হইছে?” আমি মৃদু হাসলাম চাচার কথা শুনে। এদের কীভাবে বুঝাবো যে,মৃত্যু বয়স হিসেব করে আসে না? মৃত্যু যখন তখন যে কাউকে এট্রাক করতে পারে। হোক সেটা পিচ্চি কোনো বাচ্চা কিংবা থুড়থুড়ে বুড়ো। বেশ কয়েকদিন যাবতই এই মৃত্যু জিনিসটা বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে আমাকে। সবসময়ই মনে হয়,এই বুঝি এখনই মরে যাবো আমি। এইতো সুস্থ-স্বাভাবিকই আছি আমি। কিন্তু তাতে কী? মৃত্যু কি সুস্থ লোকদের স্পর্শ করতে পারে না? অবশ্যই পারে। মৃত্যু নিয়ে এতশত ভাবনা থেকেই ভাবলাম কাফনের কাপড়টাও কিনে রাখি। এতে করে যতবার কাপড়টা দেখবো ততবারই মৃত্যুর কথা আরো গভীরভাবে স্মরণ হবে। মৃত্যুর ভয়ে আল্লাহর আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করবে,একদম কাছে,একদম! এই জিনিসটা যে ভীষণ জরুরী,ভীষণ! দোকানদার চাচাকে যখন বললাম, “বেশি দামী কাপড় দেয়ার দরকার নেই। সবচেয়ে কম দামী যেটা সেইটাই দিন।” চাচা তখন আরো একবার অবাক হলেন।
সাধারণত কাফনের কাপড়ের ক্ষেত্রে মানুষ নিজের সাধ্যমতো সবচেয়ে দামী কাপড়টাই কেনার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা বুঝে না যে,কাফনের কাপড় দামী দেয়ার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই। উমর ইবনে খাত্তার রা. তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, “তোমরা আমার কাফনের কাপড়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ীতা অবলম্বন করো। কারণ, আল্লাহ তা’য়ালার নিকট যদি আমার কল্যাণের ফয়সালা হয়ে থাকে তাহলে তিনি আমাকে এর চেয়ে উত্তম কাপড়ের মাধ্যমে তা পরিবর্তন করে দেবেন। আর যদি এর বিপরীত হয়,তাহলে এটাও খুব দ্রুতই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবেন।” অথচ আমরা এটা না বুঝে কাফনের কাপড়ের ক্ষেত্রে বরং দামী কাপড় খোঁজার চেষ্টা করি।
মূলত সমাজের প্রচলিত রিতীর বিরুদ্ধে গিয়ে কাফনের জন্য কম দামী কাপড় চাওয়াতেই চাচা হয়তো মনে মনে বিষম খেয়ে যান। আমি চাচার ভেতরের এই অভিব্যক্তি টা বুঝলাম। তাই হেসে বললাম, “আসলে চাচা, কাফনের কাপড় কম দামি হওয়াই শ্রেয়! দামী কাপড় পরার অধিকার মৃত ব্যক্তির চেয়ে জীবিত ব্যক্তিরই বেশি। ” সেদিনের পর থেকে আমি আমার চূড়ান্ত গন্তব্যে পরিহিত করে যাওয়ার উদ্দেশ্য কিনে আনা সেই এক টুকরো কাপড় প্রতিদিনই একবার করে হলেও ছুঁয়ে দেখি। নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেই সেই এক টুকরো কাপড়ের। সেই সাথে অনুভব করি মৃত্যু আমার খুব কাছে, খুউউব! এইতো, সে এসে পরল বুঝি! কিন্তু আমি? আমি প্রস্তুত তো?